প্রত্যেকটি মানুষের কাছে প্রয়োজনীয় একটি সম্পদ হচ্ছে জমি। আপনার জমি নেই বা অনেক জমি থাকলেও জমি ক্রয় করার আগ্রহ থেকেই যায়। তাই ই-পর্চা বা খতিয়ান বের করার নিয়ম ও অনলাইনে জমির মালিকানা যাচাই করার উপায় সম্পর্কে বিস্তারিত জানা সকলের জন্য অতীব জরুরী। বাংলাদেশ ভূমি মন্ত্রণালয় ভূমি সেবায় ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার শুরু করেছে। ফলে যে কেউ এখন অনলাইনে জমির মালিকানা যাচাই করা কিংবা মোবাইলেই জমির খতিয়ান বের করে নিতে পারবে।
পর্চা / খতিয়ান বলতে কি বুঝায়?
পর্চা একটি ফার্সি শব্দ। যার মানে হল জমি চিহ্নিত করার জন্য দলিল। জমি দখল, জমির মালিকানা নির্ধারণ এবং ভূমি উন্নয়ন কর নির্ধারণের উদ্দেশ্যে জরিপের মাধ্যমে প্রস্তুতকৃত নথি খতিয়ান / পর্চা নামে পরিচিত। এটি শুধুমাত্র ভূমি অধিকারের একটি রেকর্ড কিন্তু এটি মালিকানার একটি দলিল নয়। প্রত্যেকটি উপজেলা কয়েকটি ছোট ছোট প্লটে বিভক্ত করা হয়। এই প্লটগুলোকে মৌজা নামে পরিচিত করা হয়ে থাকে।
প্রত্যেকটি মৌজাকে একটি করে নম্বর / সংখ্যা দেওয়া হয়। সংখ্যাটি মৌজা নম্বর নামে পরিচিত হয়ে থাকে। অনেক জায়গায় এটি জুরিসডিকশন লিস্ট নম্বর নামেও পরিচিত। মৌজাগুলো আবার কয়েকটি প্লটে বিভক্ত। এই সংখ্যাটি সাধারণত উত্তর-পশ্চিম বিন্দু থেকে শুরু হয় এবং দক্ষিণ-পূর্ব বিন্দু পর্যন্ত শেষ হয়। একটি নির্দিষ্ট মালিক বা একাধিক মালিকের একাধিক প্লট থাকতে পারে। একটি খতিয়ান একটি/আরো সম্পূর্ণ প্লট বা একটি প্লটের অংশের জন্য খোলা থাকে। মৌজা অনুযায়ী শতাধিক খতিয়ান একত্রে আবদ্ধ। তাই খতিয়ানদের ওপর নির্ভর করে সংখ্যায় বাড়তে পারে। ভূমি উন্নয়ন কর প্রদানের জন্য তহসিল অফিসে একটি পৃথক জোট নম্বরও দেওয়া হয়।
ই-পর্চা বলতে কি বুঝায় ?
ই-পর্চা (#eporcha, #ই-পর্চা) অথবা ইলেক্ট্রনিক পর্চা হল জমি-জমা সংক্রান্ত এমন একটি সেবা প্রক্রিয়া যেখানে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহার করে জনগণকে সেবা প্রদান করা হয়। ইহা এক ধরনের “তথ্য-প্রযুক্তি” ভিত্তিক সেবা। পূর্বে জমির মালিকগন জমিজমার রেকর্ড / নথি সংগ্রহের জন্য অনেক ভোঘান্তির শিকার হতে হতো। তারা সঠিকভাবে জানত না কিভাবে সহজে জমির পর্চা অফিস থেকে সংগ্রহ করতে হয়।
কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশ ভূমি মন্ত্রণালয় ই-পর্চা (www.eporcha.gov.bd) নামে একটি ওয়েবসাইট শুরু করেছে এবং এই ওয়েবপোর্টালটি ব্যবহার করে ভূমি সংক্রান্ত বিভিন্ন সেবা গ্রহন খুব সহজে ব্যবহার করা যাবে। বাড়ীতে বসেই যে কোন কম্পিউটার কিংবা স্মার্টফোনে ইন্টারনেট সংযোগ ব্যবহার করে এই সেবা গ্রহণ করা যাবে এবং এতে করে কোন প্রকার দালাল কিংবা মধ্যস্ত বাক্তি বা অফিসের প্রয়োজন হবে না। আরএস, সিএস, এস এ, সহ যে কোন খতিয়ান / দাগ নং দেখা কিংবা সার্টিফাইড কপির জন্য এর মাধ্যমে আবেদন করা যাবে এই ওয়েবসাইটে। সীমিত টাকা দিয়ে যে কোন খতিয়ানের অনলাইন কপি দ্রুত সময়ে বের করা যাবে। বর্তমানে বাংলাদেশের ৬৪টি অর্থাৎ সব জেলায় ই-পর্চা সেবা চালু আছে।
জমির মালিকানা অনলাইনে যাচাই করার প্রক্রিয়াঃ
সাধারণত যে সকল জমির ক্রেতাগন জমি ক্রয় করবেন তারা খুব সহজেই ক্রয়কৃত জমির খতিয়ান অনলাইনে যাচাই করে নিতে পারেন। এজন্য তাদেরকে যে কোন মোবাইল ডিভাইস কিংবা পিসি থেকে যে কোন ব্রাউজার ওপেন করে টাইপ করতে হবে www.eporcha.gov.bd । ই পর্চা সাইটটি ওপেন হলে উপরের নেভিগেশন মেনু থেকে “নাগরিক কর্ণার” বাটনটিতে ক্লিক করতে হবে এবং নিচের মত করে একটি ফরম আসবে।
উপরে প্রদর্শিত আবেদন ফর্মটিতে বিভাগের ঘরে বিভাগ, জেলার ঘরে জেলা, খতিয়ানের ঘরে খতিয়ানের টাইপ (সি এস, এস এ, আর এস ইত্যাদি), উপজেলা, মৌজা সিলেক্ট করুন। এরপর খতিয়ান নং ঘরে খতিয়ান নাম্বার দিতে হবে এবং “ক্যাপচা কোড লিখুন” ঘরে পাশের ক্যাপচা নাম্বার লিখে “অনুসন্ধান করুন” বাটনটি ক্লিক করুন। আপনার দেয়া তথ্যগুলো সঠিক থাকলে নিচে জমির মালিকের নাম দেখাবে। এরপর আবেদন বাটনটিতে ক্লিক করে খতিয়ানের অনলাইন কপি কিংবা সাটিংফাইড কপি সংগ্রহ করতে পারবেন।
ই-পর্চা / খতিয়ানের অনলাইন কপি / সার্টিফাইড কপি বের করার নিয়মঃ
কারো সাহায্য ছাড়াই আপনি আপনার হাতের স্মার্টফোন দিয়ে জমির খতিয়ান বের করতে পারবেন। এজন্য আপনাকে আপনার ফোন থেকে টাইপ করতে হবে www.eporcha.gov.bd ।
অনলাইনে জমির খতিয়ান সংগ্রহের জন্য ওয়েবসাইটে “নাগরিক কর্ণার” নামে একটি অপশন রয়েছে। উক্ত অপশনে গিয়ে বিভাগের ঘরে বিভাগ, জেলার ঘরে জেলা, উপজেলার ঘরে উপজেলা ও মৌজার ঘরে মৌজার নাম বাছাই করতে হবে। খতিয়ান নম্বর / দাগ নম্বর দিতে হবে। জমির মালিকানা নাম, পিতা বা স্বামীর নাম দিয়ে খতিয়ান খোঁজা যাবে।
এছাড়া খতিয়ানের সার্টিফাইড কপি পাওয়ার জন্য অনলাইনে আবেদন করা যাবে, আবেদন নিষ্পত্তি বিষয়ে ট্র্যাকিং ও কর্তৃপক্ষ কর্তৃক মনিটরিং করার সুবিধা রয়েছে । অনলাইনে খতিয়ানের কপি বের করার জন্য অনলাইনে আবেদনের সময় নাগরিকের নাম, পরিচয়পত্র নম্বর, ফোন নম্বর ইত্যাদি তথ্য দিতে হবে। নির্ধারিত তথ্য দেয়ার পর মোবাইল ব্যাংকিং বা অনলাইন ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে খতিয়ানের জন্য ভূমি মন্ত্রণালয় কর্তৃক নির্ধারিত ফি জমা দিতে হবে। ফি পরিশোধের পর অনলাইন কপি সংগ্রহ করতে চাইলে অনলাইন কপি প্রিন্ট করে নেওয়া যাবে।
সার্টিফাইড কপি পাওয়ার জন্য আবেদনের সময় নাগরিকের তথ্য প্রদানের পর মোবাইল ব্যাংকিং বা অনলাইন ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে খতিয়ানের জন্য ভূমি মন্ত্রণালয় কর্তৃক নির্ধারিত ফি জমা দিতে হবে। ফি জমা দেয়ার পর সার্টিফাইড কপির জন্য মালিকের নাম, জাতীয় পরিচয়পত্র নাম্বার, ই-মেইল, মোবাইল নম্বর, ট্রানজেকশন আইডি ও ডাকযোগে যোগাযোগের ঠিকানা দিয়ে অনলাইনে আবেদন করতে হবে। এরপর সংশ্লিষ্ট জেলা অফিস থেকে বা আবেদনকারীর প্রত্যাশিত ঠিকানায় ডাকযোগে নির্দিষ্ট দিনের মধ্যে আরএস খতিয়ানের সার্টিফাইড কপি সরবরাহ করা হবে। এতে করে কোন প্রকার দালালের চক্রে পড়ে কোন ধরনের হয়রানি কিংবা আর্থিকভাবে ক্ষতি হওয়ার ভয় থাকে না।
মৌজার ম্যাপের অনলাইন আবেদন করার নিয়মঃ
অনলাইনে জমির মৌজা ম্যাপ সংগ্রহের জন্য ওয়েবসাইটে “নাগরিক কর্ণার” নামে একটি অপশন রয়েছে। উক্ত অপশনে গিয়ে বিভাগের ঘরে বিভাগ, জেলার ঘরে জেলা, উপজেলার ঘরে উপজেলা ও মৌজার ঘরে মৌজার নাম বাছাই করতে হবে। খতিয়ান নম্বর / দাগ নম্বর দিতে হবে। বিস্তারিত জানার জন্য এই সাইটটি ভিজিট করতে পারেন https://www.eporcha.gov.bd/khatian-search-panel.
ভূমি সেবার হটলাইন নাম্বার:
ভূমি সংক্রান্ত নানাবিধও বিষয় সম্পর্কে আপনার জানার প্রয়োজন হতে পারে। গ্রামের দেওয়ানী কিংবা মাতবরের কাছ থেকে আপনি সঠিক তথ্য নাও পেতে পারেন। তাছাড়া ভূমি / জমি-জমা সংক্রান্ত যে কোন বিষয়ে সঠিকভাবে জানার জন্য আমরা আপনাকে পরামর্শ দিচ্ছি যে আপনি এই নাম্বারে কল করুন। ভূমি সংক্রান্ত সেবার হট লাইন নাম্বারটি হলঃ 16122। আপনি ছুটির দিন ব্যতিতঃ যে কোনদিন উক্ত নাম্বারে কল করে সেবা নিতে পারবেন।
পর্চা / খতিয়ানের শ্রেণিবিন্যাসঃ
১। জরিপ খতিয়ান | ২। বিএস খতিয়ান |
৩। এস এ খতিয়ান | ৪। আরএস খতিয়ান |
৫। বিএস খতিয়ান | ৬। সিএস খতিয়ান ইত্যাদি. |
৭। শহর জরীপ |
খতিয়ানের শ্রেণিবিন্যাস
20 টিল/ 06 ডন্টো = 1 ক্রান্তি/ কনটো। 03 ক্রান্তি/ কনটো = 1 কোরা।
04 কোরা = 01 গোন্ডা। 20 গোন্ডা = 01 আনা/কানি।
16 Aana = 01/ 01 টাকা। 16 কানি = 01 দ্রোণ।
01 গোন্ডা = 2 শটক/ দশমিক। 01 গোন্ডা = 1.2 কাঠা।
01 গোন্ডা = 864 বর্গফুট। 01 কাঠা = 715 বর্গফুট।
01 শটক/ দশমিক = 432 বর্গফুট।
প্রয়োজনীয় প্রশ্ন ও উত্তরঃ
প্রশ্নঃ খতিয়ান বের করার নিয়ম সম্পর্কে ?
উত্তরঃ জমির খতিয়ানের মূলত জমির দখলদারের নাম তার ঠিকানা তার পিতার নাম তার বংশের নাম এবং তার এই সকল জিনিস দেওয়া থাকে। জমি কতটুকু রয়েছে এবং সেই জমির অবস্থান কোথায় এবং তার সীমানা এই খতিয়ানে উল্লেখ করা থাকে
প্রশ্নঃ আমি গাজীপুর থেকে মোঃ শিপন মিয়া আমার একটা পর্চা প্রয়োজন ছিল। আমি পর্চাটি কিভাবে পেতে পারি?
উত্তরঃ ধন্যবাদ আপনার প্রশ্নের জন্য। পর্চা বা খতিয়ানের নাম্বার দিয়ে অনলাইন গিয়ে ই-পর্চা সাইটে সার্চ দেন। দাগ নাম্বার বা মালিকের নাম দিয়ে খুঁজে পর্চা বের করতে পারবেন।
প্রশ্নঃ আমি চকোরিয়া হইতে জামাল মিয়া। অনেক চেষ্টা করেও আমি সাইটে লগইন করতে পারছি না ; খতিয়ান বের করতে পারছি না ?
উত্তরঃ খতিয়ান দেখার জন্য আপনাকে লগইন করার প্রয়োজন নেই। ওয়েবসাইটে গিয়ে “নাগরিক কর্ণার” বাটনে ক্লিক করে খাতিয়ান নাম্বার কিংবা দাগ নাম্বার অথবা মালিকের নাম দিয়ে সার্চ দিলে এই খতিয়ানটি কোন কোন বাক্তির নামে আছে তাদের সকলের নাম দেখাবে। যদি অনলাইনে উক্ত খতিয়ানটি ডাউনলোড করতে চান তাহলে অনলাইনের মাধ্যমে আবেদন করতে হবে। এ জন্য ভূমি মন্ত্রণালয় কর্তৃক নির্ধারিত ফি পরিশোধ করতে হবে। বিস্তারিত জানতে হলে আমাদেরকে মেইল করুন।
প্রশ্নঃ মৌজাতে ক্লিক করলে মৌজার নামের তালিকা আসে না কেন?
উত্তরঃ আপনার সমস্যাটি আমাদেরকে একটি স্কিনশট দিয়ে মেইল করুন।
প্রশ্নঃ বি.এ, সি.এ,বি.আর.এস ইত্যাদিতে কী বোঝায়?
উত্তরঃ বি.এ, সি.এ,বি.আর.এস হল খতিয়ানের বিভিন্ন প্রকারভেদ। বাংলাদেশে সাধারণ চার প্রকার খতিয়ান আছে। এগুলো হল – সিএস, এস এ, আর এস ও বিএস বা সিটি জরিপ। বিস্তারিত #পর্চা / খতিয়ানের শ্রেণিবিন্যাস ইনফোটি দেখুন।
প্রশ্নঃ অনলাইনে সার্টিফাইড কপির জন্য আবেদন করতে পারছি না। শুধুমাত্র অনলাইন সিলেক্ট করা আছে।
উত্তরঃ আপনার প্রধানকৃত থানা অথবা জেলায় সম্ভবত সার্টিফাইড কপি দেয়া আপাতত বন্ধ আছে। এইজন্য আপনি জেলা রেকর্ড রুম এ যোগাযোগ করতে পারেন।
সর্বশেষে বলতে চাই যে, ভূমি মন্ত্রণালয় কর্তৃক ই-পর্চা (www.eporcha.gov.bd) নামে ওয়েবসাইটটি ব্যবহার করে ভূমি সংক্রান্ত বিভিন্ন সেবা গ্রহন করা এখন সাধারন মানুষের জন্য খুবই সহজলভ্য হয়েছে। এখন একজন মানুষ তার বাড়ীতে বসেই যে কোন কম্পিউটার কিংবা স্মার্টফোনে ইন্টারনেট সংযোগ ব্যবহার করে এই সেবা গ্রহণ করতে পারবে এতে করে তাকে কোন প্রকার দালাল কিংবা মধ্যস্ত বাক্তি বা অফিসে যাবার প্রয়োজন হবে না। আসুন আমরা সবাই এখন থেকে ই-পর্চা / খতিয়ানের জন্য অনলাইনের এই সেবাটি গ্রহন করি।