কালোজিরার উপকারিতা, কালোজিরার ইংরেজি নাম Fennel flower, Blackseed or Black caraway বাংলা নাম কালিজিরা, কালোজিরা, কালো কেওড়া, রোমান ধনে ইত্যাদি। কালোজিরার উপকারিতা অনেক। কালোজিরার আদি নিবাস দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়া। কালিজিরার গাছে একবার ফুল ও ফল হয়। এর স্ত্রী, পুরুষ দুই ধরনের ফুল হয়, রং সাধারণত হয় নীলচে সাদা পাঁচটি পাঁপড়ি বিশিষ্ট, কিনারায় একটা বাড়তি অংশ থাকে। এর গোলাকার ফল হয় এবং প্রতিটি ফলে ২০-২৫ টি বীজ থাকে। তিন-কোনা আকৃতির কালো রং এর বীজ হয় যাকে বলে কালোজিরা। আয়ুর্বেদীয়, ইউনানী, কবিরাজী ও লোকজ চিকিৎসায় ব্যবহার হয়। মশলা হিসাবে ব্যাপক ব্যবহার হয়ে থাকে কালোজিরার, এটি পাঁচ ফোড়নের একটি উপাদান। কালোজিরার বীজ থেকে পাওয়া যায় তেল। ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা কালিজিরাকে একটি অব্যর্থ রোগ নিরাময়ের উপকরণ হিসেবে বিশ্বাস করে। হাদিসে আছে কালোজিরা মৃত্যু ব্যতীত অন্য সব রোগ নিরাময় করে। এজন্য কালোজিরাকে সব রোগের ওষুধ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।

কালোজিরায় সে সকল উপাদান থাকে
কালোজিরাতে প্রায় শতাধিক পুষ্টি ও উপকারী উপাদান আছে। এর প্রধান উপাদানের মধ্যে আমিষ- ২১ শতাংশ, শর্করা- ৩৮ শতাংশ, স্নেহ বা ভেষজ তেল ও চর্বি- ৩৫ শতাংশ। এছাড়াও ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ আছে। প্রতি গ্রাম কালোজিরা পুষ্টি উপাদান হলোঃ প্রোটিন- ২০৮ মাইক্রোগ্রাম; ভিটামিন বি১- ১৫ মাইক্রোগ্রাম; নিয়াসিন- ৫৭ মাইক্রোগ্রাম; ক্যালসিয়াম- ১.৮৫ মাইক্রোগ্রাম; আয়রন- ১০৫ মাইক্রোগ্রাম; ফসফরাস- ৫.২৬ মিলিগ্রাম; কপার- ১৮ মাইক্রোগ্রাম; জিংক- ৬০ মাইক্রোগ্রাম; ফোলাসিন- ৬১০ আইউ। কালোজিরার অন্যতম উপাদানের মধ্যে আরও আছে নাইজেলোন, থাইমোকিনোন ও স্থায়ী তেল। পাশাপাশি কালোজিরার তেলে আছে লিনোলিক এসিড, অলিক এসিড, ফসফেট, লৌহ, ফসফরাস, কার্বোহাইড্রেট, ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, আয়রন, জিংক, ম্যাগনেশিয়াম, সেলেনিয়াম, ভিটামিন-এ, ভিটামিন-বি, ভিটামিন-বি২, নিয়াসিন ও ভিটামিন-সি ছাড়াও জীবাণুনাশক বিভিন্ন উপাদান থাকায় কালোজিরার উপকারিতা অপরিসীম।
কালোজিরার উপকারিতা
কালোজিরা নিজেই একটি অ্যান্টিবায়োটিক বা অ্যান্টিসেপটিক। কালিজিরায় রয়েছে প্রচুর পরিমাণ ফসফরাস। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে বাড়াতে সাহায্য করে ফসফরাস। তাই জীবাণুর সংক্রমণ ঠেকাতে কালিজিরার অবদান অপরিসীম।
১. কালিজিরাতে রয়েছে প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। এগুলো প্রদাহ নিরাময় করে। অক্সিডেটিভ স্ট্রেস হ্রাস করে। লিভারকে সুরক্ষিত রাখে। রাসায়নিকের বিষক্রিয়া কমাতে পারে কালিজিরা। লিভার ও কিডনিকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে।
২. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে শক্তিশালী করে কালিজিরা। নিয়মিত কালিজিরা খেলে শরীরের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সতেজ থাকে। যে কোনো জীবাণুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে, লড়াই করতে সহায়তা করে। সার্বিক ভাবে স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়।
৩. মাথা ব্যথায় কালোজিরার উপকারিতা অবাক করার মত, কপালে উভয় চিবুকে ও কানেরপার্শ্ববর্তি স্থানে দৈনিক ৩/৪বার কালোজিরার তেল মালিশ করূন। ৩ দিন খালি পেটে চা চামচে এক চামচ করে তেল পান করুন। সচরাচর মাথাব্যথায় মালিশের জন্য রসুনের তেল, তিল তেল ও কালোজিরার তেলের সংমিশ্রণ মাথায় ব্যবহার করুন আর কালোজিরার উপকারিতা আপনি নিজে দেখে নিন।
৪. চুলপড়া কমাতে লেবু দিয়ে সমস্ত মাথার খুলি ভালোভাবে ঘষুণ। ১৫ মিনিট পর শ্যাম্পু দিয়ে ধুয়ে ফেলুন ও ভালোভাবে মাথা মুছে ফেলুন। তারপর মাথার চুল ভালোভাবে শুকানোর পর সম্পুর্ন মাথার খুলিতে কালোজিরার তেল মালিশ করুন। ১ সপ্তাতেই চুলপড়া বন্ধ হবে।মাথার যন্ত্রনায় কালোজিরার তেলের সাথে পুদিনার আরক দেয়া যায়। এক্ষেত্র পুদিনার টীংচার রসুনের তেল, তিলতেল, জলপাই তেল ও কালোজিরার তেল একসাথে মিশিয়েও নেয়া যেতে পারে।
৫. স্মৃতিশক্তি বাড়ে ও অ্যাজমায় উন্নতি ঘটায় কালোজিরা, এক চামচ মধুতে একটু কালোজিরা দিয়ে খেয়ে ফেলুন। এতে স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি পায়। হালকা উষ্ণ পানিতে কালোজিরা মিলিয়ে ৪৫ দিনের মতো খেলে অ্যাজমার সমস্যার উন্নতি ঘটে।
৬. কফ ও হাঁপানীর সমস্যায় বুকে ও পিঠে কালোজিরারতেল মালিশ। এক্ষেত্রে হাঁপানীতে উপকারী অন্যান্য মালিশের সাথে এটা মিশিয়েও নেয়া যেতে পারে। রীতিমতো হোমোওপ্যাথিক ওষুধ আভ্যন্তরীন প্রয়োগ।
৭. অ্যাসিডিটি ও গ্যাস্টিক অপসারণে কালোজিরার উপকারিতা অনেক এক কাপ দুধ ও এক টেবিল চামুচ কালোজিরার তেল দৈনিক তিনবার ৫-৭ দিন সেবন করতে হবে। এতে গ্যাস্টিক কমে যাবে।
৮. কিডনিতে পাথর ও ব্লাডার সমস্যায় ২৫০ গ্রাম কালোজিরা ও সমপরিমান বিশুদ্ধ মধু নিন। কালোজিরা উত্তমরূপে গুড়ে করে মধুর সাথে মিশ্রিত করে দুই চামচ মিশ্রন আধাকাপ গরম পানিতে মিশিয়ে প্রতিদিন আধা চা কাপ পরিমাণ তেলসহ পান করতে হবে।
৯. মেদ ও হৃদরোগ এ চায়ের সঙ্গে নিয়মিত কালোজিরা মিশিয়ে অথবা এর তেল মিশিয়ে পান করলে হৃদরোগে যেমন উপকার হয়, তেমনি মেদ কমে যায়।
১০. বদহজম সমস্যায় নিয়মিত পেট খারাপের সমস্যা থাকলে কালোজিরা সামান্য ভেজে গুঁড়ো করে ৫০০ মিলিগ্রাম হারে ৭-৮ চা চামচ দুধে মিশিয়ে সকালে ও বিকেলে সাত দিন ধরে খেলে ভালো ফল পাওয়া যায়। ডায়রিয়া সেলাইন ও হোমিও ওষুধের পাশাপাশি ১ কাপ দই ও বড় এক চামচ কালোজিরার তেল দিনে ২ বার ব্যবস্থেয়। এর মুল আরকও পরীক্ষনীয়।
১১. জ্বর হলে সকাল-সন্ধ্যায় লেবুর রসের সঙ্গে এক টেবিল চামুচ কালোজিরা তেল পান করুণ। আর কালোজিরার নস্যি গ্রহণ করুন।
১২. যৌন-দুর্বলতা কালোজিরা চুর্ণ ও যয়তুনের তেল (অলিভ অয়েল), ৫০ গ্রাম হেলেঞ্চার রস ও ২০০ গ্রাম খাটি মধু = একত্রে মিশিয়ে সকাল খাবারের পর ১চামচ করে সেব্য। কালোজিরার মূল আরক, হেলেঞ্চা মুল আরক, প্রয়োজনীয আরো কোন মুল আরক অলিভ অয়েল ও মধুসহ পরীক্ষনীয়।
১৩. ওজন কমায় কালোজিরা যারা ওজন কমাতে চান, তাদের খাদ্য তালিকায় উষ্ণ পানি, মধু ও লেবুর রসের মিশ্রণ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এখন এই মিশ্রণে কিছু কালোজিরা পাউডার ছিটিয়ে দিন। পান করে দারুণ উপকার পাবেন।
১৪. চেহারার নমনীয়তা ও সৌন্দর্যবৃদ্ধি অলিভ অয়েল ও কালোজিরা তেল মিশিয়ে অঙ্গে মেখে ১ ঘন্টা পর সাবান দিয়ে ধুয়ে ফেলন।
১৫. দাঁত শক্ত করে কালোজিরা, দই ও কালোজিরার মিশ্রণ প্রতিদিন দুবার দাঁতে ব্যবহার করুন। এতে দাঁতে শিরশিরে অনুভূতি ও রক্তপাত বন্ধ হবে।
১৬. নিয়মিত কালিজিরা খেলে দেহে রক্ত সঞ্চালন ভালো হয়। এতে করে মস্তিষ্কে রক্ত সঞ্চালনের বৃদ্ধি ঘটে, যা আমাদের স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে।
১৭. নিয়মিত কালিজিরা খাওয়ালে শিশুর দৈহিক ও মানসিক বৃদ্ধি দ্রুত হয়।
১৮. সন্তান প্রসবের পর কাঁচা কালিজিরা পিষে খেলে শিশু দুধ খেতে পাবে বেশি পরিমাণে।
১৯. মধুসহ প্রতিদিন সকালে কালোজিরা সেবনে স্বাস্থ্য ভালো থাকে ও সকল রোগ মহামারী হতে রক্ষা পাওয়া যায়।
২০. দাঁতে ব্যথা হলে কুসুম গরম পানিতে কালিজিরা দিয়ে কুলি করলে ব্যথা কমে; জিহ্বা, তালু, দাঁতের মাড়ির জীবাণু মরে।
২১. কালিজিরা কৃমি দূর করার জন্য কাজ করে। কালোজিরার উপকারিতা মেধার বিকাশের জন্য কাজ করে দ্বিগুণ হারে।
২২. কালিজিরা নিজেই একটি অ্যান্টিবায়োটিক বা অ্যান্টিসেপটিক। দেহের কাটা ছেঁড়া শুকানোর জন্য কাজ করে। নারীর ঋতুস্রাবজনীত সমস্যায় কালিজিরা বাটা খেলে উপকার পাওয়া যায়।
২৩. তিলের তেলের সাথে কালিজিরা বাঁটা বা কালিজিরার তেল মিশিয়ে ফোড়াতে লাগালে ফোড়ার উপশম হয়।
মধুর উপকারিতা ও খাঁটি মধু চেনার উপায়
কালোজিরা ব্যবহারের সর্তকতা

কালোজিরার উপকারিতা যেমন বলে শেষ করা যাবে না, তেমনি সঠিক নিয়মে সেবন না করলে এর অপকারিতাও আছে। তাই কালোজিরা সেবনে আমাদের কিছু সর্তকতা অবলম্বন করতে হবে।
- কালিজিরা নিয়মিত ও পরিমিত খেতে হয়।
- খুব বেশি খেলে বা ব্যবহার করলে বিপরীত হয়।
- নকল বা কৃত্রিম কালিজিরার তেল কখনও খাওয়া ঠিক না।
- গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত কালিজিরা খেলে গর্ভপাতের সম্ভাবনা থাকে।
- গর্ভাবস্থায় ও দুই বছরের কম বয়সের বাচ্চাদের কালিজিরার তেল সেবন করানো উচিত নয়।
- যারা কালিজিরা হজম করতে পারেন না। তারা খাবেন না, তবে আস্তে আস্তে অভ্যাস করলে ভালো।
- পুরনো কালিজিরা তেল স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকারক।